“২৫ ডিসেম্বর: একটি দিন, একটি অনুভূতি
২৫ ডিসেম্বর—এই তারিখটা কেবল ক্যালেন্ডারের একটি সংখ্যা নয়, এটি মানুষের অনুভূতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এক গভীর উপলব্ধি। এই দিনটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে পৃথিবী যতই অস্থির হোক, যতই মানুষে মানুষে বিভেদ থাকুক, ভালোবাসা আর মানবতা এখনো সবকিছুর ঊর্ধ্বে। খ্রিস্টমাস ডে মূলত যীশু খ্রিস্টের জন্মদিন হিসেবে পরিচিত হলেও, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই দিনটি ধর্মের গণ্ডি পেরিয়ে মানুষের হৃদয়ের উৎসবে পরিণত হয়েছে। যীশু খ্রিস্টের জন্ম হয়েছিল কোনো রাজপ্রাসাদে নয়, কোনো ঐশ্বর্যপূর্ণ পরিবেশেও নয়, বরং একটি সাধারণ গোয়ালঘরে—এই ঘটনাই নীরবে আমাদের শেখায় যে মহান হতে গেলে ক্ষমতা বা সম্পদের প্রয়োজন হয় না, প্রয়োজন হয় বিশুদ্ধ মন, বিনয় আর মানুষের জন্য নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। তাঁর জীবন ছিল এক চলমান শিক্ষা, যেখানে তিনি বারবার মানুষকে ক্ষমা করতে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে শান্তভাবে দাঁড়াতে এবং দুর্বল মানুষের পাশে থাকার কথা বলেছেন। আজকের পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে এই শিক্ষাগুলো আরও বেশি প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়, কারণ আমরা ক্রমশ ব্যস্ত, আত্মকেন্দ্রিক আর সংবেদনহীন হয়ে উঠছি। খ্রিস্টমাস আমাদের থামতে শেখায়, একটু গভীরভাবে ভাবতে শেখায়—আমি কি সত্যিই একজন ভালো মানুষ হতে পারছি। এই দিনটি কেবল আলো, সাজসজ্জা, গান বা উৎসবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি মানুষের ভেতরের আলো জ্বালানোর দিন। আমরা যখন খ্রিস্টমাসের কথা বলি, তখন অনেকেই উপহার, কেক, নতুন জামাকাপড় কিংবা আনন্দের মুহূর্তের কথা ভাবি, কিন্তু এই সবকিছুর আড়ালে লুকিয়ে থাকে একটি গভীর বার্তা—ভালোবাসা ভাগ করে নেওয়া। একজন একাকী মানুষের পাশে বসে একটু কথা বলা, দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকা কাউকে খোঁজ নেওয়া, কিংবা আর্থিকভাবে দুর্বল কাউকে সামান্য সাহায্য করা—এই ছোট ছোট কাজগুলোই খ্রিস্টমাসের আসল সৌন্দর্য। আজকের দিনে সবচেয়ে দামী উপহার কোনো দোকানে পাওয়া যায় না; সবচেয়ে দামী উপহার হলো সময়, যত্ন আর আন্তরিকতা। একজন বাবা-মায়ের সঙ্গে বসে কিছু সময় কাটানো, সন্তানদের মন খুলে কথা শোনা, বন্ধুর ভুলগুলো ক্ষমা করে দেওয়া—এসবই এমন উপহার, যা জীবনে গভীর ছাপ ফেলে। খ্রিস্টমাস আমাদের শেখায় যে ধর্ম আলাদা হতে পারে, বিশ্বাস আলাদা হতে পারে, কিন্তু মানুষের কষ্ট, হাসি আর স্বপ্ন সবারই এক। এই দিনটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে মানুষকে বিচার করার আগে তার জায়গায় নিজেকে একবার দাঁড় করানো দরকার। ভারতে খ্রিস্টমাস মানে এক অনন্য মিলনচিত্র, যেখানে বিভিন্ন ধর্ম, ভাষা আর সংস্কৃতির মানুষ একসঙ্গে আনন্দ ভাগ করে নেয়। চার্চে প্রার্থনার সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ঘরে কেকের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ে, রাস্তায় আলো জ্বলে ওঠে, আর মানুষের মুখে দেখা যায় এক ধরনের প্রশান্ত হাসি। কলকাতা, গোয়া, কেরালা কিংবা দেশের যে কোনো প্রান্তেই খ্রিস্টমাস মানুষের হৃদয়কে কাছাকাছি এনে দেয়। এই দিনটি আমাদের নিজের ভেতরের মানুষটার সঙ্গে কথাও বলতে শেখায়। আমরা নিজের কাছে প্রশ্ন করতে পারি—আমি কি অজান্তে কাউকে কষ্ট দিয়েছি, আমি কি কাউকে ক্ষমা করতে পারি, আমি কি আমার রাগ, অহংকার আর হিংসা একটু হলেও কমাতে পারি। এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার মধ্যেই খ্রিস্টমাসের প্রকৃত অর্থ লুকিয়ে আছে। খ্রিস্টমাস মানে নতুন করে শুরু করার সাহস, পুরনো দুঃখ আর ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার মানসিকতা। এই দিনটি আমাদের শেখায় যে আলো সবসময় অন্ধকারকে হার মানায়, আর ভালোবাসা সবসময় ঘৃণার চেয়ে শক্তিশালী। পৃথিবী যতই কঠিন হোক, মানুষের ভেতরের মানবিকতাই পারে সবকিছুকে বদলে দিতে। আজ যদি আমরা সিদ্ধান্ত নিই যে আমরা কাউকে অকারণে কষ্ট দেব না, কাউকে ছোট করে দেখব না, আর নিজের সামান্য সামর্থ্য দিয়ে হলেও কারও জীবনে একটু আলো এনে দেব, তাহলেই এই দিন সার্থক হবে। খ্রিস্টমাস আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে বড় পরিবর্তন শুরু হয় ছোট ছোট সিদ্ধান্ত থেকে। একটি হাসি, একটি ক্ষমা, একটি সাহায্যের হাত—এই সবই সমাজকে ধীরে ধীরে সুন্দর করে তোলে। আজকের দিনে আমরা যদি একটুখানি থেমে নিজের ভেতরের অন্ধকারগুলোকে চিহ্নিত করতে পারি এবং সেগুলোর জায়গায় আলো জ্বালানোর চেষ্টা করি, তাহলেই খ্রিস্টমাস শুধু একটি দিন হয়ে থাকবে না, হয়ে উঠবে একটি মানসিকতা। ২৫ ডিসেম্বর আমাদের শেখায় কীভাবে ভালো মানুষ হওয়া যায়, কীভাবে সহানুভূতিশীল হওয়া যায়, আর কীভাবে মানুষের পাশে দাঁড়ানো যায় কোনো প্রত্যাশা ছাড়াই। আজকের দিনে এই একটাই কামনা—ভালোবাসা ছড়িয়ে পড়ুক, মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বাস ফিরে আসুক, আর এই পৃথিবী একটু হলেও শান্ত, সুন্দর আর মানবিক হয়ে উঠুক। শুভ বড়দিন, এই দিন আমাদের সবার জীবনে আলো, আশা আর মানবতার বার্তা বয়ে আনুক।

Comments
Post a Comment